খবিস জীনের গল্প
দুপুরে খাবার খাওয়ার সময় ছোট বোনটাকে মজার ছলে 'খবিশ' বলাতে বাবা রেগেমেগে ঝাড়ি মেরে বললেন,' এইসব ল্যাংগুয়েজ কোত্থেকে শিখেছো তুমি? খবিশের মানে জানো? আর কখনো এসব বলবা না।'
বাবাকে হঠাৎ করে এভাবে চড়াও হতে দেখে আমার গলায় ভাত আটকে গেলো। দ্রুত হাতে মা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বাবাকে খানিকটা বকার ভংগিতে বললো,' তুমিও না। সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। ও-কি আর অতশত ভেবে বলেছে নাকি। রুপাকে তো মাঝেমধ্যেই এটা ওটা বলে খ্যাপায়।'
বাবা গম্ভীরমুখে বললো,'তারপরও এসব বলবে না। 'খবিশ' কোনো উল্টাপাল্টা জিনিস নয়,যে এটা মজার ছলে কোনো মানুষকে সম্বোধন করবে।'
পানি খাওয়ার পর নিজেকে প্রকৃতিস্থ করে নিয়ে বললাম,' বাবা আমি রুপাকে কোনকিছু খারাপ ভেবে বলিনি। আচ্ছা খবিশের মানে কি?'
বাবা আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। তারপর বললো,'যেটার মানেই জানো না,সেটা আরেকজনকে বলো কীভাবে? খবিশ কোনো সাধারণ জিনিস নয়। এটা শয়তান জগতের একটা ভয়ংকর বদ জ্বিনের নাম। যারা মূলত বাথরুমের পিছনে,হাসপাতালের ভাগাড় সহ পঁচা-দুর্গন্ধযুক্ত নোংরা জায়গাতে বাস করে আর সেখানকার খাবার খায়। একজন শিক্ষিত, ভদ্রঘরের সন্তান হয়ে এসব অরুচিকর ভাষা কোত্থেকে শিখেছো তুমি?'
মা,বাবাকে আবার ধমকের স্বরে বললো,'থামবে তুমি। ছেলেটাকে কি একটু শান্তিতে খেতেও দিবে না? খোকা এখন চুপচাপ খেয়ে নে।'
মায়ের বকা খেয়ে বাবা আর কিছু বললো না তখনকার মত।
তবে আমার মনে একটা খচখচানি থেকেই গেলো। আসলেই কি খবিশ কোনো শয়তানের নাম! আমি তো এতদিন এটা রূপক অর্থে অনেককেই বলে এসেছি।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পার্ট চুকিয়ে, বিকেলে টিউশনির জন্য বার হতে যাব,মা এসে বললো,' খোকা একটু পর আমরা সবাই তোর মামা বাসায় যাব। তুইও চল।'
আমি টিউশনির বাহানা দেখিয়ে তাদেরকে যেতে বলে বেরিয়ে যাওয়া ধরলে মা আবার বললো,' আজকে আমরা না-ও আসতে পারি। তোর মামা আগামীকাল ভোরে চলে যাবে। আমরা যদি না আসি তাহলে ফ্রিজে খাবার রাখা থাকবে,বাড়ি ফিরে রাতে একটু গরম করে খেয়ে নিস কেমন?'
আমি মাথা নাড়িয়ে 'হ্যাঁ' সূচক উক্তি জানিয়ে বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে। টিউশনি শেষ করে আরও একটা কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ খানিকটা রাত হয়ে গেলো। সন্ধ্যার সময় মা কল করে জানিয়ে দিয়েছে, তারা আজকে আর ফিরবে না,আমি যেন ফ্রিজের খাবারটা গরম করে রাতে খেয়ে নিই। অন্যদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেও আজ ইচ্ছা করেই একটু দেরিতে ফিরলাম। খালি বাড়ি একা একা কি করবো। স্ট্রিট ফুড খেয়ে পেট ভরা ছিলো,কাজেই রাতে বাড়ি ফিরে আর ফ্রিজের খাবার গরম করা লাগলো না।
রাত তখন নয়টা। ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ মোবাইল টিপে তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম মনে নেই,ঘুমের ভিতরে বিশ্রী একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে গেলো আবার।
স্বপ্নে দেখলাম, আমার ছোট বোন রুপা আমাদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে যেই ভাগাড়টা আছে সেখানে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। রুপাকে বসে থাকতে দেখে ছুটে গেলাম সেদিকে, তারপর দেখলাম সে দু হাতে একটা বার্গার চেপে ধরে ক্ষুধার্ত হায়েনার মত গোগ্রাসে খাচ্ছে! বার্গারটা থেকে বিশ্রী রকমের পঁচা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে নাকে,মাছিতে ভিনভিন করছে! দৃশ্যটা দেখে গা গুলিয়ে উঠলো আমার।
রুপাকে এমন বাসি খাবার খেতে দেখে রেগেমেগে ওর হাত থেকে বার্গার টা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিতেই, রুপা যেন আরও হিংস্র হয়ে উঠলো। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার হাতটা খপ করে ধরে ওর দাঁতকপাটি সজোরে বসিয়ে দিয়ে খানিকটা মাংস খুবলে নিয়ে বিশ্রী একটা হাসি হেসে বললো,' তোর এত বড় সাহস আমার মুখ থেকে খাবার কেড়ে নিস। আমার অনেক খিদে,খাবার দে। নয়তো তোকে খাব।'
ঘুম ভেঙে দেখি পুরো শরীর ঘেমে স্যাঁতসেঁতে হয়ে গিয়েছে। বুকটা রীতিমতো হাপরের মত উঠানামা করছে। বিছানায় উঠে বসে ডান হাতটা চেক করে নিলাম,না সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। কিন্তু গা গুলাচ্ছে,মনে হচ্ছে এখনি বমি হয়ে যাবে। বিছানা ছেড়ে জোর পায়ে বাথরুমে গিয়ে হড়হড় করে মুখ ভরে বমি করার পর খানিকটা স্বস্তি মিললো।
বমি করার পর বেসিন থেকে মুখ তুলতেই বুকটা কেঁপে উঠলো আমার। বাথরুমের ভেন্টিলেটরের ওপাশে একজোড়া জলন্ত চোখ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে! সামনের মিররে সেই চোখজোড়া দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালাম পিছনে। কিন্তু কোথায়?
ভেন্টিলেটরের ওপাশটা পুরো ফাঁকা, একরাশ গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। চোখের ভ্রম বলে নিজেকে বুঝ দিয়ে চোখেমুখে ঠান্ডা পানির ছাঁটা মেরে তোয়ালেটা দিয়ে মুখ মুছতে গিয়ে মনে হলো ঘাড়ের কাছে কেউ একজন গভীর সন্তপর্ণে এসে দাঁড়িয়েছে। তার গরম নিঃশ্বাস আমার কাঁধে এসে আঁচড়ে পড়ছে।
মুখের উপর থেকে তোয়ালেটা সরিয়ে ভয়ে ভয়ে পিছন ঘুরে তাকালাম,না কেউ নেই৷ বাথরুমের ভিতরে আবার কে আসবে এত রাতে? নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য খানিকটা হাসি পেলো এবার। তোয়ালেটা আবার যথাস্থানে রেখে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম। কেমন একটা অস্বস্তিবোধ লাগছে নিজের ভিতরে। ঘরের চারপাশের আবহাওয়া খানিকটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এমনটা তো আগে কখনো হয়নি। উঠে গিয়ে ফ্যানের স্পিড খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে তারপর বিছানায় শুয়ে পড়লাম আবার।
ঘরের বাল্ব জ্বলছে,ফ্যান ঘুরছে। তারপরও অস্বস্তিবোধটা দূর হচ্ছেনা৷ একটা বার কি মা'কে ডাকবো?
মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ঠিক ঘুম চলে আসবে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দেওয়ালে ঝুলতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকালাম একবার, ঘড়িতে সময় রাত দুটো। এতরাতে মা'কে ডাকাটা কি ঠিক হবে?
নিজের অবচেতন মন ঠিক বেঠিকের তোয়াক্কা না করে বলে উঠলো, যা, গিয়ে মা'কে ডাক দে।'
বিছানা ছেড়ে উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বাবা-মা যে ঘরটাতে থাকে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই কানে একটা শব্দ ভেসে এলো। খসখস,কচমচ,কটমট শব্দ।
অনেকটা চিপসের প্যাকেট খুললে যেমনটা হয়। থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম এবার,তারপর কান দু্টি সজাগ করে ভেসে আসা শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করলাম। আওয়াজটা রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে।
কিন্তু এতরাতে রান্নাঘরে আবার কে কি খাচ্ছে? নিশ্চয় পাশের বাড়ির বিড়ালটা জানালা খোলা পেয়ে ঢুকেছে।
বাবা-মায়ের ঘর উপেক্ষা করে এবার রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। এক পা এক পা করে যতই এগিয়ে যাচ্ছি আওয়াজটা ততোই জোরালো হচ্ছে আরও।
ধিরে ধিরে এগিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়াতেই দেখলাম, রান্নাঘরের এক কোণে রুপা দাঁড়িয়ে আছে। খানিকটা ঝুঁকে পড়ে রান্নাঘরের কোণায় রাখা ময়লার বালতি টাতে কিছু একটা খুঁজছে সে।
সাতপাঁচ না ভেবে এগিয়ে গেলাম রুপার দিকে। তারপর রুপার কাঁধে হাত দিয়ে বললাম,' কিরে এতরাতে রান্নাঘরে কি করছিস তুই?'
রুপা কোনো উত্তর করলো না। তার মুখ থেকে খসখস একটা শব্দ বার হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা খাচ্ছে সে।
কিন্তু এই নোংরা ফেলা বালতির সামনে দাঁড়িয়ে সে কি এমন খাচ্ছে?
দু হাত দিয়ে জোর করে রুপাকে এবার নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতেই ভয়ে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো।
রুপার হাতে একটা নীল রঙের পলিথিন, সেই পলিথিনের ভিতরে মাছের এঁটো কাটা,আঁশ আর দুপুরের আহারের পর বেঁচে যাওয়া সেই খাবারের উচ্ছিষ্ট আছে। রুপা সেগুলোই গোগ্রাসে খাচ্ছে! দৃশ্যটা দেখে আতকে উঠলাম আমি। বললাম,' এই রুপা ওগুলো কেন খাচ্ছিস? কি হয়েছে তোর?'
রুপা কোন উত্তর করলো না। পলিথিনের ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে দিয়ে সেগুলো ভক্ষণ করতে লাগলো আরও তৃপ্তি সহকারে। রুপার খাওয়া দেখে আবার গা গুলিয়ে উঠলো আমার। রুপাকে এইমূহুর্তে আমার মোটেও স্বাভাবিক লাগছেনা,একটু আগের দেখা সেই দুঃস্বপ্নটা যেন স্ব শরীরে এসে দাঁড়িয়েছে বাস্তবে! রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বাবা-মায়ের ঘরের সামনে গিয়ে কয়েকবার দরজায় টোকা মারার পর মনে হলো, বাবা-মা তো কেউ বাড়িতে নেই। তারা তো বিকেলে মামার বাসায় গিয়েছে। এমনকি রুপাও!
তাহলে এইমাত্র রান্নাঘরে যাকে দেখলাম, কে সে!
কথাটা মনে হতেই মেরুদণ্ড বেয়ে ভয় জড়ানো ঠান্ডা স্রোত খেলে গেলো! হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপছে রীতিমতো।
দৌড়ে গিয়ে যে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিবো সেই শক্তিটুকুও বোধহয় নেই।
ভয়ে তটস্থ হয়ে বাবা-মায়ের ঘরের দরজার কাছ থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম, রুপা রান্নাঘর ছেড়ে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওর ঠোটে অজস্র মাছি ভিনভিন করছে। চোখ গুলো অসম্ভরকমের লাল। সম্পূর্ণ অচেনা ভয়ংকর এক মানবী এসে উপস্থিত হয়েছে সামনে। কেন জানি মনে হলো,এই চোখ জোড়ায় একটু আগে বাথরুমের আয়নায় দেখেছিলাম আমি। আতঙ্কে বাকশক্তি হারিয়ে গেছে আমার। নির্বাক, নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি রুপার দিকে তাকিয়ে। রুপার ঠোঁট জুড়ে একটা বাঁকা হাসি খেলে বেড়াচ্ছে। ঠোটের নিচে লেগে থাকা মাছের আঁশ জিহ্বা দিয়ে চেটে নিয়ে ধির পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,' কি হলো ভয় পাচ্ছিস কেন? আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। আমার অনেক খিদে পেয়েছে খাবার দে।'
মুখ দিয়ে কোনো উত্তর বেরুলো না আমার। সব কথা যেন কণ্ঠনালির নিম্নদেশে এসে আটকে গিয়েছে।
ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে বসে পড়লাম আমি। রুপা ধির পায়ে আরও কাছে এগিয়ে আসতে লাগলো আমার। ওর চোখমুখে হিংস্রভাবটা আরও প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে। পুরো বাড়িটা কেমন একটা বিশ্রী উৎকট গন্ধে ভরে উঠেছে।
রুপা এগিয়ে আসতে আসতে ঘ্যাড়ঘেড়ে কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,' এতদিন যে কথায় কথায় আমাকে ডাকতিস,এইযে আমি এসে গিয়েছি। এখন আমায় খুশি কর। আমার অনেক খিদে,ভাগাড়ের খাবার খেয়ে যে পেট ভরেনা আমার। দে খাবার দে আমায়। নয়তো তোকে খেয়ে খিদে মেটাবো।'
কথাগুলো বলে রুপা বিভৎস শব্দ করে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। সেই হাসি পার্থিব জগতের কোনো মানুষের হাসি হতে পারেনা, যেন নরকের গহ্বর থেকে উঠে আসা বিভীষিকাময় কয়েকশো নরকের কিটের সমলিত যান্ত্রিব কণ্ঠধ্বনি। ভয়ে আতঙ্কে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো আমার। চোখ বন্ধ হওয়ার শেষ মূহুর্তে রুপার সেই বিভৎস চেহারাটা শেষবারের মত দেখলাম আরও একবার।
.....চোখ মেলে তাকাতেই, নিজেকে বিছানায় আবিস্কার করলাম। শিয়রে মা বসে আছে,একপাশে বাবা আর রুপা দাঁড়ানো। রুপাকে দেখে আতকে উঠতেই মা কোনরকমে শান্ত করলো আমাকে।
তারপর বললো,' খোকা কি হয়েছে তোর? বাসায় ফিরে দেখি রান্নাঘরের সবকিছু লণ্ডভণ্ড, পুরো ঘর জুড়ে মাছের আঁশ আর খাবারের উচ্ছিষ্ট ছড়ানো ছেটানো আর তুই দরজার সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছিস। কি হয়েছে খোকা?
আমি মনে মনে গতরাতের সবটা মনে করার চেষ্টা করে নিয়ে তারপর ধরা গলায় বললাম,'মা, গতরাতে খবিশ এসেছিলো।'
কথাটা শুনে বাবা-মা আর রুপা তিনজনেই আমার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো৷
সমাপ্ত..
খবিশ
আশিক_মাহমুদ