ভুুতের গল্প ৩১ হাওর এলাকার দানো
রফিকদের গ্রামের বাড়ি দুর্গম এক
অজপাড়াগায়ের শেষ
সীমান্তে অবস্থিত । ইলেক্ট্রিসিটির
আলো এখনো ওই গ্রামকে আলোকিত
করতে পারেনি । হাওর এলাকায়
রফিকদের বাড়ি । বাড়ির
চারপাশে অসংখ্য হাওর আর খালবিল
। বর্ষার পানিতে হাওড়গুলো থই থই
করছে ! আর সেই থই থই
করা পানিতে দিনে দুপুরে অসংখ্য
জিওল মাছ লাফালাফি করে ।
গতকাল রাতে এই বিলের পানিতেই
ডুবে মরেছে রফিকের মা আছিয়া বানু
।
কিভাবে মারা গেছে , কেন
মারা গেছে এই নিয়ে গ্রামের
কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদের
জল্পনা কল্পনার শেষ নেই । হাওর
এলাকায় অসংখ্য পিশাচের
আনাগোনা নাকি গ্রামের মানুষ
বিভিন্ন সময় লক্ষ্য করেছে । অন্ধকার
চাঁদহীন রাতে হাওরের
পারে বসে ওরা নাকি কচকচ
করে কাচা মাছ চিবিয়ে খায় । এই সময়
কেউ যদি তাদের
আশেপাশে হেটে যায় ,
গলা ধরে বিলের
পানিতে তাকে চুবিয়ে মারে পিশাচের
দল , গ্রামের অশিক্ষিত
মানুষগুলো প্রবল ভাবে এসব
কথা বিশ্বাস করে ।
কাচারি ঘরের চৌকিতে চিৎ
হয়ে শুয়ে আছে রফিক । মায়ের মৃত্যুর
কথা শুনে সকালেই
ঢাকা থেকে গ্রামে এসেছে সে ।
মায়ের জানাজা শেষ
করে সারাটাদিন এই
চৌকিতে পরে রইল সে । দিন
গড়িয়ে সন্ধ্যা আসল , সন্ধার পরে আসল
ঝিঝিডাকা রাত । শুয়ে শুয়ে মায়ের
কথা ভাবছে সে ।
কান্নাটাকে আটকে রাখার
চেষ্টা করছেনা সে । নিরবে , সবার
অগোচরে বহু দুর্গম এক গ্রামের এক
ঘরে এক যুবক তার সদ্যমৃত মায়ের জন্য
কাঁদছে । কাদুক ।
মায়ের মৃত্যুর কারণটা নিয়ে অনেক
ভেবেছে সে । তার মা তো সাতার
জানে , তাহলে পানিতে ডুবল
কিভাবে ? অবশ্য গ্রামের মানুষদের
মত কুসংস্কারে বিশ্বাস করেনা সে ।
কিন্তু অজানা এক আতঙ্কে কেন যেন
রফিক বার দুয়েক কেঁপে উঠল । সাত পাচ
ভাবতে ভাবতে রফিক ঘুমের রহস্যময়
জগতে ডুবে গেল ।
রফিকেরা দুই ভাই । রফিকের ছোট ভাই
পড়াশুনায় খুব মেধাবি ছিল । মনোবসু
স্কলারশিপ
নিয়ে জাপানে পড়ছে সে । হুট
করে জাপান থেকে চলে আসা যায়
না, তাই ভাইকে ছাড়াই মায়ের
জানাজা দিল রফিক ।
সন্ধ্যার পরেই
গ্রামটাকে প্রাগৈতিহাসিক কালের
রহস্যঘেরা আঁধার তার কাল চাদর
দিয়ে ঢেকে দেয় । গ্রামের ভয়ার্ত
মানুষগুলো সন্ধ্যার পর দরজায় খিল
লাগিয়ে ঘুম দেয় । প্রাচীন ,
ঝিঝিডাকা , নিকষকালো রাতে ওই
গ্রামে নেমে আসে যেন মৃত্যুপুরীর
নিস্তব্ধতা । কখনো কখনো পিছের ওই
বাঁশঝাড় থেকে ভেসে আসা রাত
জাগা পাখির কর্কশ গর্জনে রাতের
নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায়
।
গভীর রাতে খুব ঠাণ্ডা কিছুর
স্পর্শে রফিকের ঘুম ভাঙ্গে ।
অজানা আতঙ্কে রফিকের মেরুদণ্ড
দিয়ে যেন ঠাণ্ডা পানি বয়ে যাওয়ার
কথা , কিন্তু কেন যেন রফিকের
অনুভুতিগুলো ভাবলেশহীন হয়ে গেছে !
অশরীরী কোন কিছুর উপস্থিতি তার
বাস্তব জ্ঞান কেড়ে নিয়েছে !
তাকে করেছে সম্মোহিত !
চাদের আবছা আলোয় রফিক দেখল
তার চৌকিতে তার মা বসে আছে ।
অশরীরী জিনিসটা আজ
আছিয়া বেগমের ছদ্মবেশ
নিয়ে এসেছে রফিকের কাছে ! জীবন
দরকার তার ! অনেক জীবন !!
রফিকের একবারও মনে পড়ল না গতকাল
তার মা মারা গিয়েছে । গতকাল তার
জানাজা হয়ে গেছে !!
একদৃষ্টিতে রফিকের চোখের
দিকে তাকিয়ে রয়েছে আছিয়া বেগম
। আছিয়া বেগম
ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলেন ।
সম্মোহিতের মত
মা রূপী অশরীরী আত্মাটার
পিছে পিছে হাঁটছে রফিক ।
যেতে যেতে ওরা উত্তরের জলার
পাড়ে গিয়ে থামল ।
পরের দিন বাড়ির উত্তরের জলায়
গ্রামবাসী রফিকের লাশ
ভেসে থাকতে দেখল ।
(সমাপ্ত)