ভয়ংকর লাশের গল্প
#অ্যাম্বুলেন্স
আমি পেশায় একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক। গত আট বছর ধরে জীবিকার জন্য লা'শবাহী অ্যাম্বুলেন্স চালাচ্ছি। অনেক ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখেছি, কিন্তু গত ৫ মাস আগে যা ঘটেছিল, তা এখনও ভুলতে পারছি না। আমি জানি না, এটা আমার দোষ ছিল নাকি অন্য কিছু, কিন্তু সেই রাতের স্মৃতি আমাকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। আমার গ্রামের বাড়ির পাশের বাড়ির হালিম চাচা কে আমি ঢাকার এক সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসি চিকিৎসার জন্য, ক্যান্সার এর রোগী ছিলেন। ওনার একটাই ছেলে, থাকে ওমান, পরিবারে তার স্ত্রী ছাড়া আর কেও নেই বাড়িতে। সরকারি হাসপাতালে আমার পরিচিত লোক থাকায়, হালিম চাচার ছেলের অনুরোধে আমি তাকে ঢাকায় এনে সেই হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেই এবং প্রতিদিন কাজের ফাঁকে তার দেখা শুনা করি, যতটুকু সম্ভব হয়। ডাক্তার বলেছিল তার অবস্থা তেমন ভালো না।
সেদিন ছিল একেবারে সাধারণ একটা দিন। সন্ধ্যার দিকে একটা ফোন পেলাম হাসপাতাল থেকে – হালিম চাচা আর নেই। বিস্মিত হইনি, অবস্থা আগে থেকেই ভালো ছিল না তেমন, কিন্তু চোখের কোণে একটু পানি চলে এলো, কারণ যেই কয়দিন এখানে ছিল, আমি ই দেখা শুনা করতাম। অনেক ভার আক্রান্ত মন নিয়ে তার ছেলে কে আর গ্রামে তার স্ত্রী কে ফোনে জানালাম। ঠিক হলো আমার অ্যাম্বুলেন্সে করে আমি ই নিয়ে যাবো গ্রামে। আমার হেল্পার রাতুলের ছেলে হয়েছে আগেরদিন, তাই ও ছিল ছুটিতে। আমাকেই লা'শ নিয়ে একা যেতে হবে।
রাত প্রায় দশটা বাজে, যখন আমি রওনা হলাম। লা'শ'টি কফিনে ছিল, যথারীতি পেছনের দিকে অ্যাম্বুলেন্সের লা'শ রাখার জায়গায় রেখে দিলাম। রাতুল অনেক সময় না থাকলে আমি একাই যাত্রা করি, এতে কোনো সমস্যা হয় না। তবে সেদিন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। কেন যেন মনে হচ্ছিল, কেউ আমার পাশেই বসে আছে, কিন্তু পেছনের আয়নায় তাকিয়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না।
ঢাকা থেকে বেরিয়ে গ্রামের পথে ঢুকতেই রাস্তা আরও ফাঁকা হয়ে গেল। অ্যাম্বুলেন্সের হেডলাইট কুয়াশার মধ্যে পথ কেটে এগিয়ে চলছিল। রাস্তায় কোনো মানুষজন নেই, শুধু মাঝে মাঝে শেয়াল ডাকছিল। আমার গ্রামে যাওয়ার রাস্তাই তো এইটা, কত গাড়ি চালিয়ে গিয়েছি, কিন্তু সেদিন আমার মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, কেন জানি মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঠিক নেই।
রাত প্রায় বারোটা বাজে, আমি একটা চা-স্টলে গাড়ি থামালাম। এক কাপ চা নিয়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। স্টলে কেউ ছিল না, শুধু দোকানদার ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ মনে হল, যেন অ্যাম্বুলেন্সের পেছন থেকে একটা চাপা আওয়াজ এলো, যেন কিছু একটা নড়ছে! মনে হলো, হয়তো কফিনের ভেতর লা'শ'টা সরে গেছে। গাড়িতে উঠে পেছনের দিকে তাকালাম। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কফিনটা খালি! আমি তো স্পষ্ট দেখেছি, হাসপাতালের লোকজন লা'শ ভেতরে রেখেছে, তারপর ঢাকনা বন্ধ করে দিয়েছিল। তাহলে লা'শ গেল কোথায়? মাথায় হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
আমি গাড়ি থেকে নেমে চারপাশে খোঁজাখুঁজি করলাম, কিন্তু কোথাও লা'শে'র চিহ্ন নেই। গাড়ির দরজা তো লক ছিল, তাহলে কফিনের ভেতরের লা'শ উধাও হলো কীভাবে?
চা-স্টলের দোকানদার হঠাৎ জেগে উঠল। আমি কাঁপা গলায় তাকে বললাম,
— "ভাই, আপনি কিছু দেখেছেন?"
— "কী দেখব?"
— "অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে লা'শ গায়েব হয়ে গেছে!"
দোকানদার আমার কথা শুনে কিছু বলল না, শুধু চারপাশে তাকিয়ে চোখ বুলালো। কিছুক্ষণ পর বলল,
— "ভাই দোয়া দুরুদ পড়ে আপনি একটু আশপাশে খোঁজেন। গত সপ্তাহেও একটা লা'শে'র গাড়ির সাথে এমন ঘটেছে, পরে রাস্তার ওই পরের ঝোপঝাড়ের মধ্যে পেয়েছে লা'শ।"
আমি দ্রুত গাড়ির চারপাশে টর্চলাইট মেরে দেখতে লাগলাম। রাস্তার ধারে ঝোপঝাড়ের দিকে তাকাতেই বুক ধড়ফড় করে উঠল— এক জায়গায় সাদা কাপড়ের মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। আমি কাছে যেতেই দেখলাম, সেটি লা'শে'র কাফনের কাপড়!
কিন্তু লা'শ নেই!
গাছের নিচে কাপড় পড়ে আছে, আর আমি ধীরে ধীরে উপরের দিকে তাকালাম। এক মুহূর্তের জন্য আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল— হালিম চাচার লা'শ'টি গাছের ডালে ঝুলে আছে!
কীভাবে সম্ভব? কফিন থেকে বেরিয়ে লা'শ গাছের ডালে উঠল কীভাবে? আমি স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। এক লাফে পিছিয়ে এলাম। লা'শ'টা এমনভাবে ঝুলছিল, যেন কেউ ইচ্ছা করে রেখে গেছে। এত রাতে একা একা দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পাচ্ছিলাম না। দোকানদারকে ডাকতে গেলাম কিন্তু সে আমার সাথে আসতে রাজি হলো না। অন্য কারো লা'শ হলে আমি লা'শ রেখেই পালাতাম, কিন্তু এইটা তো আমার পরিচিত লোক। যা করার আমাকেই করতে হবে।
আমি গাড়ি ঝোপঝাড়ের দিকে মুখ করে, হেডলাইট জ্বালিয়ে দিলাম। তারপর ধীর পায়ে গাছের দিকে এগোলাম। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। লা'শ'টা'কে নামাবো, না পুলিশ ডাকবো?
আমি গাছের নিচে গিয়ে দেখলাম হয়তো আমি হাত বাড়ালেই হালিম চাচার ডান পা টা ধরতে পারবো। আমি লা'শে'র দিকে হাত বাড়াতেই, এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো, হঠাৎ যেন একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল, আর পর মুহূর্তেই লা'শ'টা খসে পড়লো। কিন্তু মাটিতে পড়ার বদলে, অন্ধকারের মধ্যে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল!
আমি দৌড়ে অ্যাম্বুলেন্সের কাছে গেলাম। দরজা খুলেই দেখি, কফিনের ভেতরে লা'শ আবার শুয়ে আছে! ঠিক যেমনটা হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছিলাম! আমি ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। এত কিছু দেখার পরও, আমি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে দ্রুত রওনা দিলাম। গাড়ির আয়নায় পেছনে তাকিয়ে দেখি কফিন এর উপর বসে আছে একটা কালো ছায়া মূর্তি, কোনো চোখ মুখ নেই, কিন্তু একটি কালো ছায়া। পেছন ফিরে তাকানোর সাহস আমার হয়নি। কোনো কিছু আর না ভেবে দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে আমি গাড়ি চালিয়েছি, আর চালানোর সময় যেই ৩ বার তাকিয়েছি আয়নায়, সেই ৩ বার ই আমি ছায়াটা দেখেছি, কফিন এর উপরে।
গ্রামে হালিম চাচার বাড়ি পৌছালাম রাত ৪ টায়। তার বাড়ির সামনে আত্মীয় প্রতিবেশী অনেকেই দাড়িয়ে ছিল। গাড়ি থেকে তাদের দেখে মনে একটা শান্তি অনুভব করলাম, মনে হলে এক ঝাঁক ভয় কেটেছে। তারা এসে কফিন নামালো, কফিন খুললো, আর আমি দেখলাম— লা'শ ঠিকঠাক মতোই আছে, যেমনটি থাকার কথা! আমি কাউকে কিছু বললাম না। হয়তো বললেও কেউ বিশ্বাস করত না।
লা'শ দাফন হলো, আমি ঢাকায় না যেয়ে, আমার বাড়িতে চলে এলাম। টানা ১০ দিন আর বাড়ি থেকে বের হইনি। ঘর থেকে অ্যাম্বুলেন্স এর দিকে তাকালেই মনে হতো, সেই ছায়াটা হয়তো এখনো আমার অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে আছে। ভেবেছিলাম আর এই অ্যাম্বুলেন্সের কাজ করবো না, কিন্তু এই কাজে যেই টাকা পাই, অন্য কাজ করে আমার পরিবার চালানো কষ্ট হয়ে যাবে।
সেই রাতের রহস্য আজও আমার কাছে অমীমাংসিত। হয়তো ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তার কারণে আমার মস্তিষ্ক বিভ্রম তৈরি করেছিল, অথবা সত্যিই কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। আমি জানি না, তবে এরপর থেকে রাতে একা লা'শ বহন করি না, না পারতে পেছনের আয়নায় তাকাই, তাকালেও ভয়ে ভয়ে। কারণ আমি জানি, কখনো কখনো কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেয়ে সেগুলো ভুলে যাওয়াই ভালো।
লেখকঃ ডাঃ জাবেদুল হক পাটোয়ারী