রাতে অনিক ভাইয়ার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা

অতিপ্রাকৃত কোন কিছুই আমাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়নি,তাই আমার পক্ষে ভূতের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করা খানিকটা শক্তই বটে। কিন্তু নিজ পরিবারের একাধিক সদস্যের কথা অবিশ্বাস করাও আমার পক্ষে কঠিন। তারা একটি অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল এবং আজও সেই ঘটনার ভুক্তভোগী। আজ আমি আমার পরিবারের সেই ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে যাচ্ছি। জানিনা বলাটা ঠিক হবে কিনা,তবুও এই ভয়ংকর সত্যিটা সকলকে অবগত করার একটা অদৃশ্য আগ্রহ অনুভব করছি। যাই হোক,মূল ঘটনায় আসছি।
.
২০১২ সালে বরিশালের বরগুনা জেলায় বসবাসরত আমার খালাতো বোন সান্টির বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আমাদের পরিবারের যে কোন বিয়ের অনুষ্ঠান বরগুনার বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে আয়োজিত হয়ে থাকে। রেওয়াজ মত সেবারও এটাই করা হল।
আমার খালামনিদের বাসা থেকে মিলনায়তনটির ক্ষুদ্র দূরত্ব ছিল। হেটে যেতে প্রায় ১৫ মিনিটের মত লাগত। বিয়েতে আমি ছাড়া পরিবারের বাকি সকল সদস্য উপস্থিত ছিল। গায়ে হলুদের দিন রাতে বিয়ে বাড়ির সকলে ঠিক করল গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষে সকলে বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে গিয়ে বিয়ের আসন এবং অন্যান্য সব ব্যবস্থা কি রকম চলছে তা পরখ করে আসবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সকলে মিলে রাত ১২ টার পর মাইক্রোতে রওয়ানা হলো সেখানে। বলে রাখা ভালো, মিলনায়তনে যাওয়ার পথে অনেক বড় একটা খাসপুকুর এবং তার পাশে বড় বড় তালগাছ ছিল,তার আশেপাশে ও সামনে পেছনের জায়গাগুলো ছিল জঙ্গল প্রকৃতির আর ভীষণ নির্জন। মিলনায়তনে যাওয়ার পর সেখান থেকে আসতে আসতে রাত ২ টা বেজে গেল। মাইক্রো ড্রাইভারকে ছোট মামি আগেই বিদায় দিয়ে দিয়েছিল। বাড়ি কাছে হওয়ার কারনে সকলে মিলে হৈচৈ করে হেটে যাওয়ার প্ল্যান করলো।
তো যথারীতি সকলে ধীরগতিতে হাটছিল। হৈচৈ করার কথা থাকলেও কেন জানি সেরকম কিছুই করা হচ্ছিল না। চারদিকে সুনসান নীরবতা। দম আটকে আসার মত নিস্তব্ধতা বিরাজমান ছিল। সবাই নিচু আওয়াজে গল্পগুজবে বিভোর ছিলো। খাসপুকুরের কাছাকাছি আসার পরই হঠাত্‍ আমার এক কাজিন চিত্‍কার করে উঠল। সবাই সামনের দিকে তাকিয়ে যা দেখল তা তারা বিশ্বাস করতে পারছিলো না।
প্রায় ৭ হাত দূরত্বে ১২-১৩ বছর বয়সী সাদা জোব্বা এবং লম্বা টুপি পরিহিত একদম হুবহু একই পোশাকের, একই আকৃতির, এবং একই গড়ণের ১০-১২ টা ছেলে তাদের দিক থেকে পেছন ফিরে উল্টো দিকে উল্টো পায়ে হাটছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল একে অপরের কার্বন কপি। এত রাতে এই জংলি এলাকা দিয়ে এত ছোট ছেলেদের যাওয়া আসার কোন প্রশ্নই ছিল না। এদের হাটার ধরণ দেখে সবাই বুঝতে পারলো যে এগুলো মানুষ নয়। তারা এটা দেখে ভয়ে জমে গেলো। চিত্‍কার চেচামেচি করতে শুরু করল। তারপর পেছন দিক ফিরে জোরে জোরে হাটা শুরু করলো। একসাথে এতগুলো লোক চোখে ভুল দেখতে পারেনা।
আমার একটা খালাতো ভাই অনিক। ও ছিল অত্যাধিক সাহসী। সুপার ন্যাচারাল ব্যাপারে বরাবরই ওর মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহল ছিলো। ও সাহস করে পেছনে তাকালো। কিন্তু আর কিছুই দেখতে পেল না। এতক্ষন যে এখানে কিছু ছিলো তা বোঝার কোন উপায় ছিলো না। ঐগুলো মানুষ হলে কোনদিনও এত তাড়াতাড়ি ঐ স্থান ত্যাগ করতে পারত না। যাই হোক, ও সকলকে আশ্বস্ত করলো যে সামনে আর কিছু নেই। সকলে তাড়াতাড়ি করে বাড়ির দিকে এগোতে শুরু করলো। কিন্তু তত্‍ক্ষণাত সামনের খাসপুকুরের বীপরিত পাড়ে প্রচুর বাতাস বইতে শুরু করলো। তালগাছের পাতাগুলো এমন ভাবে নড়ছিলো যে দেখে মনে হচ্ছিল ঝড় এসেছে। কোনমতে সবাই দোয়া দুরূদ পড়তে পড়তে দৌড়তে লাগলো। সে রাতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সকলে বাড়ি ফিরল। বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের ঘটনা খুলে বললো। বেশ কিছুক্ষন পর সকলে টের পেল যে অনিক ভাইয়া সেখানে নেই। ভাইয়াকে বাড়ির কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। ফোন করা হলো কিন্তু ওপার থেকে কেউ ফোন ধরলো না। বাধ্য হয়ে মামারা ওকে খুঁজতে বের হলো। ওকে ঐ রাস্তার কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। অবশেষে মামারা নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। সকলে সিদ্ধান্ত নিলো সকালে কিছু একটা পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ওদিকে আমার আরেক কাজিন সিফাত ভাইয়ার ওপর বিয়ের সব কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিলো। ওকে সারারাত মিলনায়তনেই থাকতে হয়েছিল। ভোর রাতে কি একটা দরকারে ওকে বন্দর যেতে বলা হয়েছিল। বন্দর যাওয়ার মেইন রোডে পুলিশের টহল ছিল,আর ভাইয়ার সাথে বাইকের লাইসেন্স ছিলো না। তাই পুলিশি ঝামেলা এড়ানোর উদ্দেশ্যে ভাইয়া বাইক নিয়ে ক্ষেতের রাস্তা দিয়ে বন্দরে যাচ্ছিল। সেখানে যেতে যেতে হঠাত্‍ ছোট একটা খড়ের গাদার পাশে একটা মানুষের দুটো পা দেখতে পেল সে। ভাইয়া ভয়ে ভয়ে কাছে এগুলো। খড়ের গাদার ভেতরে মানুষটার মুখ গোজা ছিল। খড় সরিয়ে ভাইয়া যা দেখলো তার জন্য ও মোটেও প্রস্তুত ছিল না। অনিক ভাইয়াকে জ্ঞানশূণ্য অবস্থায় আবিস্কার করল সিফাত ভাইয়া। ওকে পিটিয়ে এভাবে রেখে গেছে কেউ। ভাইয়া বাসায় ফোন করে খবর দিল। অনিক ভাইয়াকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ওর সমস্ত সমস্ত শরীরে রক্তজমাটের কালো কালো দাগ,আর খামচির দাগ। বুঝতে কষ্ট হলো না যে, কেউ তাকে নির্দয়ভাবে মেরেছে।
কয়েক ঘন্টা পর ওর জ্ঞান আসে।এরপর ওকে সবাই জিজ্ঞেস করে রাতে ওর সাথে কি ঘটেছিলো।কিন্তু ও কিছুই বলতে পারছিলো না। এরপর ওর জ্বর আসে। ৫ দিন পর জ্বর নেমে যায়,কিন্তু হাত পা অবশ হয়ে প্যারালাইসিসের মত হয়ে যায়।
ভাইয়ার সুস্থ হতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায়। আট মাস পর ভাইয়া পুরোপুরি সুস্থ হয়। এর মধ্যে ভাইয়াকে এত জিজ্ঞেস করার পরও কোনদিন একটিবারের জন্যও সে রাতের ঘটনা আমাদের খুলে বলেনি।
সে রাতের পর থেকে কিছুদিন পর পরই ভাইয়াকে রাতে একা একা কথা বলতে দেখা যায়। আর প্রায়ই ভাইয়া অনেক রকম স্বপ্ন দেখতো আর চিত্‍কার চেচামেচি করে অদ্ভূত আচরন করতো। প্রথমদিকে প্রায়ই এইরকম হত। এখন অনেক কমে গেছে। তবে এখনও ভাইয়া মাঝে মাঝেই রাতে একা একা কথা বলে।
এই ঘটনার পর আমাদের পরিবারের সবাই ঠিক করে আর কোনদিন কারো বিয়ে হলে রাতে বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনের পথে পা বাড়াবে না। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বেশিদিন বহাল থাকলো না। বিগত বছরই আমরা সবাই আমার মামাতো বোনের বিয়েতে রাতে মিলনায়তনে গিয়েছি এবং রাত ১.৪৫ এ ঐ রাস্তা দিয়েই হেটে বাড়ি ফিরেছি। এবার আর কোন ভৌতিক ঘটনা ঘটে নি।
.
কিন্তু সে রাতে অনিক ভাইয়ার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা আজও আমাদের পরিবারের কাছে একটা বড় রহস্য।