ভূতের গল্প ৬
মানুষের এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে যার কোনো ব্যাখ্যা খুজেঁ পাওয়া যায়না। আর আমি অত সহজে কোনো কিছু বিশ্বাস করিনা। আমি যুক্তিবাদী মানুষ। অনেকেই আমাকে নাস্তিক বলে। কিন্তু আমি নাস্তিক না। আমার সাথে যে গঠনাগুলো ঘটে আমি সেগুলোর ব্যাখ্যা দাড় করানোর চেষ্টা করি কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পারিনা।
আমার যতদুর মনে পড়ে আমার ৪ বছর বয়স থেকেই ঘটনার সুত্রপাত। (এর আগে ঘটে থাকলে তা আমার মনে নেই।) তখন আমরা খাগড়াছড়িতে ছিলাম। আমি তখন ও স্কুলেভর্তি হইনি। সম্ববত ১৯৯৪ সাল। আমরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাসার পাশে মাঠে খেলা করতাম। আম্মু ও আন্টিরা হাঁটাহাটি করত। তখন আমি দেখতাম মাঠে আমাদেরই মত, কিন্তু আমাদের চাইতে আলাদা কিছু মানুষ ও হাঁটাহাটি করছে। এককথায়, আমি একটা দেয়ালের সামনে দাড়ালে যেমন ছায়া পড়বে তেমন, কিন্তু ছায়াটা সাদা, টর্চ লাইটের আলোর মত সাদা। অনেকগুলো সাদা আলোর মানুষ মাঠে খেলছে, আমি আম্মুকে জিজ্ঞেস করতাম ওগুলো কি ? আম্মু বলত শেয়াল (পাশের জঙ্গলে অনেক শেয়াল ছিল,আম্মু ভাবত শেয়াল দেখে ভয় পাচ্ছি)।
এভাবে প্রতিদিনই আমি তাদের দেখতাম, আমার কাছে সেটা স্বাভাবিক ছিল। আমি ভয় পেতাম না।
কাহিনীতে কিছুটা পরিবর্তন আসে ১৯৯৭/৯৮এর দিকে। তখন আব্বুর বদলি হয়ে গেছে চট্টগ্রামে। আমি থ্রিতে পড়ি। বদলটা হল, খাগড়াছড়িতে আমি ওদের দেখতাম মাঠে, আর চট্টগ্রামে ওরা চলে যায় দেয়ালে, ছায়ার মত। অবিকল একটা মানুষের ছায়া কিন্তু টর্চ লাইটের আলোর মত উজ্জ্বল। সন্ধ্যায় খেলার সময় দেখতাম দেয়াল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অনেকগুলো আলোর মানুষ। কিন্তু ওদের পা কখনো মাটিতে লাগানো থাকতনা। শূন্যে ভাসমান থাকত। আমি ভয় পেতাম না। খেলার সাথীদের বলতাম, তারা মজা করে ধরতে যেত, কিন্তু ধরতে পারত না। (পরে জানতে পারি তারা কেউ দেখত না, দুষ্টুমি করত)
২০০৩ সালে আমরা ব্রাক্ষনবাড়িয় া চলে আসি। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। সন্ধ্যায় বের হওয়া বন্ধ। তাই আর আলোর মানুষ দেখিনা।
২০০৬ সাল। আমি এস.এস.সি পরীক্ষার্থী। গ্রাম থেকে নানু ও মামা এসেছে। পরীক্ষার আর ১৫/১৬ দিন বাকী। নানু আমারসাথে ঘুমায়। আমি রাত ১.৩০ পর্যন্ত পড়ি। হঠাত এক রাতে-
আনুমানিক রাত ৩.০০টা। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। হঠাত দেখি আমার রূমে তিনজন লোক চাঁদর মুড়ি দিয়ে হাঁটছে। তাদের গাঁ থেকে আলো ছড়াচ্ছে। মুখ দেখা যাচ্ছেনা। আমি ভয়ে পাথর হয়ে গেলাম। প্রায় ৩০ মিনিট জেগে ছিলাম। নানুকে জড়িয়ে ধরলাম। নানু বলল_ "কি হয়েছে?" আমি বললাম_ " ভয় পাই"।
সকালে আমি নানুকে জিজ্ঞেস করলে নানু বলেন সত্যিই গতরাতে গতরাতে আমি "ভয় পাই" বলেছি। (জিজ্ঞেস করার কারন আমি যুক্তি, প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করিনা) ঘটনাটা আমার স্যারের সাথে শেয়ার করলে উনি বলেন এগুলো জ্বীন। আয়াতুল কুরসী পড়ে ঘুমাতে বলেন।
এর পর কেটে গেল আরও ২ বছর।
২০০৮ সাল। আমি এইচ. এস. সি দিয়ে ঢাকা গেছি কোচিং করতে। হোষ্টেলে থাকি। হঠাতএকদিন _
স্বপ্নে দেখি আমাকে আমার বড় খালা মারছে। পেটে জোরে জোরে লাথি মারছে। আমার চোখ লাল হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি মরে যাচ্ছি। ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি কোথায় ? এরা কারা ? আমি কে ? কিছুই মনে করতে পারছিনা। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা। পেটে খুব ব্যাথা। প্রায় ১৫/২০ মিনিট। হঠাত আমার রূমমেট আমার গাধরে ঝাঁকুনি মারে। আমার সব মনে পড়ে যায়। তাকিয়ে দেখি সকাল ১১.০০ টা। তার পর দেখি আমার পেট লাল হয়ে আছে। যেন সত্যিই কেউ প্রচন্ড জোরে লাথি মেরেছে।ঘটনাটা আমার মাকে বলি। তারপর বাসায় চলে যাই। আম্মু একটা তাবিজ দিয়ে দেন। হোষ্টেলে হঠাত একদিন দেখি হাতে তাবিজ নেই। কোথাও খুঁজে পাইনা। তারপর যখন বাসায় যাই_ টানা ২১ দিন জ্বর, বমি। আর ভয়াবহ সব দুঃস্বপ্ন। প্রতিটা স্বপ্নের বিষয় বস্তু _ আমাকে মারছে, আমি মরে যাচ্ছি, মৃতু্যর এক সেকেন্ড আগে ঘুম ভেঙ্গে যেত। শরীরে খুব ব্যাথা করত। সকাল, বিকাল, দুপুর, রাত যখন তখন স্বপ্ন। এমনকি সোফায় বসে ৫ মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করলে ও স্বপ্ন চলে আসত।
তারপর, সুস্থ্য হই। হোষ্টেলে যাই। তাবিজটা খুজে পাই বিছানার তোশকের নিচে। কিন্তু তোশকের নিচে কিভাবে গেল ?
যাই হোক। ২০০৯ সালে আমরা সিলেটে। ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। আমার বয়স ১৮+।
আমার জীবনে নেমে এল ভয়াবহ বিপর্যয়। একটা রাত ঘুমাতে পারিনি। এক কথায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। স্বপ্নের মাঝে কতবার যে মৃতু্যর হাত থেকে ফিরে আসতাম...।
ভয়াবহ সেই ড্রাকুলার চেহারা আমাকে প্রতি রাতে তাড়িয়ে বেড়াত। ৫ মিনিটের জন্য ঘুমাতে পারতাম না। স্বপ্নে যে জায়গায় মারা হতো ঘুম থেকে উঠার পর সে জায়গা ব্যাথা করত। লাল হয়ে থাকত। সায়েন্স এ নাকি এ সমস্যাকে ওহাবৎঃ জবধপঃরড়হ বলে। আমার ভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ প্রায় ৩ মাস।আমি কি বলি, কি করি কিছুই মনে থাকেনা। এমনকি আমার নানা_নানু নাকি ঐসময় আমাদের বাসায় ছিলেন কিন্তু আমি আজ ও মনে করতে পারিনা। অনেকের সাথে কথা বলে জানতে পারি আমাকে নাকি তখন দেখতে অপ্রকৃতস্থের মতো দেখাত। বিশেষ করে আমার চোখ। সাধারন ও মানসিক সব ডাক্তারই দেখানো হয়েছে। তারা শুধু ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিত। আর যখন খুব সমস্যা হত, ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত। স্যালাইন দেয়া হত। আমার মনে আছে, দিনে ৭টা ইনজেকশন পর্যন্ত দেয়া হয়েছে।
আমার একপাশে ভাই আর একপাশে মা ঘুমাতো, আমি মাকে ধরে রাখতাম আর ভাই আমাকে ধরে রাখতো। কিন্তু স্বপ্নগুলো আমাকে ছাড়তোনা। আমি প্রতি রাতে চিৎকার করতাম, দিনে যখন তখন মাথা ঘুরে পড়ে যেতাম। আবোল তাবোল বকতাম।
এক হুজুর (আমি এগুলোতে বিশ্বাস করতাম না) আমাকে তেলপড়া মেখে ঘুমাতে বলল। অবিশ্বাস্যরকম ভাবে যেদিন তেলপড়া মাখতাম সেদিন রাতে স্বপ্ন দেখতামনা। যেদিন মাখতামনা সেদিন ই...।
আমাকে অসহায়ভাবে "হুজুর" বিশ্বাস করতে হলো। কিন্তু সেই হুজুর আমাকে স্পষ্ট করে কিছুই বললেননা।
শাহপরাণ মাজার এর হুজুর বললেন আমার উপর জ্বীনের নজর আছে। (আমি বিশ্বাস করিনা) আমাকে পানি পড়া আর তাবিজ দিলেন। আমি ব্যবহার করিনি। ফেলে দিয়েছি সুরমা নদীতে। আর আমার সেই"হুজুর" আমাকে একটা শরীর বন্ধের তাবিজ দিলেন যা আমি ব্যবহার করে সুফল পেয়েছি। (তাবিজ গলায় লাগাবার সাথে সাথে অবিশ্বাস্যভাবে সব ভয় চলে গেছে)
২০১০ সাল। আমি ২য় বর্ষে পড়ি।
হঠাৎ একদিন দেখি গলায় তাবিজ নেই। আমি ভয় পেলাম। তাবিজ খুঁজে পেলাম ঘরের এক কোণায়। কিন্তু আর গলায় দিলাম না। একদিন-
আম্মু অসুস্থ্য হয়েগেছে। আবোল তাবোল বকছে। হঠাৎ আমাকে ডাক দিল। "তোর যে বড় তাবিজটা আছে না, হুজুর যে দিছে, ঐটা ফেলে দে, ঐটা ভালো না, এক্ষন ই ফেলে দে যা ফেলে দে" (যদিও আম্মু পরে অস্বীকার করেছে)।
আমি ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু তাবিজ ফেললাম না। একটা কাঁচের বয়ামে রেখে দিলাম।
তারপর-
আমি আবার স্বপ্ন দেখি.....
প্রতি রাতে.....
২০১১ সাল-
একদিন রাতে বাথরূমের আয়নায় একজনকে দেখি। সেই ড্রাকুলা (অথবা অন্যকিছু)।
আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তার চেহারা কী যে ভয়ংকর, আমার অনুভুতি নাহয় না ই লিখলাম। তবে অনেক কেঁদেছি। আমার সাথেইকেন এমন হবে? আমি কি দোষ করেছি....?
এখন আমার কাছে এটা কোন ব্যাপার না। একজনের সাথে এই ঘটনা শেয়ার করেছিলাম সে বলেছে রাতের বেলা রূমের মাঝখানে বসে তার/তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে, তারা কি চায় জানতে। করিনি। কি লাভ?
ক'দিন আগে। আমার ভাইয়ের পরীক্ষা। দেখলাম, সে আকাশি রঙের আর নীল জিন্স পড়ে ডান হাতে বোর্ড নিয়ে বাম হাতে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল। একটু পড়ে দেখি সে আবার একইভাবে বেড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম "কিরে তুই ঢুকলি কখন?" সে তো পুরা অবাক। - "আমি বের হলাম কখন?" আমি বললাম- "তাহলে দুই মিনিট আগে কে গেলো?" সে বলল "মানে?" আমি বুঝতে পাড়লাম ঘটনা কি। আমি ওকে যেতে বললাম। কারণ এর আগেও এ ঘটনা দুই তিন বার ঘটেছে।শুধু ভয় পাচ্ছিলাম ওর যাতে কিছু না হয়।
আমি অনেক কিছুই বলে দিতে পারতাম। যা অন্য কেউ পারতোনা। নিজেই অবাক হতাম । যেমন- আমার বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড ভালোবাসা দিবসে কার সাথে কোথায় বেড়াতে গেছে আমি সেটা পর্যন্ত বলে দিয়েছিলাম। (যেটা এখন আর পারিনা বা পারতে চেষ্টা করিনা)
*** যারা এ লেখাটি পড়লেন আমি তাদের জায়গায় হলে এটি বিশ্বাস করতাম না। কারন আমি অবিশ্বাসিদের দলে। তবে আমি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, যার সাথে ঘটে সে ই বুঝে।।