আমার গাড়িটা চলছে লাশবাহী গাড়ির ঠিকানায় বাস্তব ভুতের গল্প

২০১৯ সালের জুলাই মাসের একটি মাঝ রাত। হঠাৎ আমার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। ঘুম ঘুম চোখে কলটা রিসিভ করে ঘড়িতে দেখলাম রাত দেড়টা বাজে। ইউজ্যুয়ালি আমি ঘুমানোর আগে আমার মোবাইল ফোনটা বন্ধ রাখি। কিন্তু এই সপ্তাহের পুরোটাই ফোনটা অন রাখতে হয়েছে। কেননা হাসিন গস গেছেন দুবাইতে আমাদের মসজিদের ইয়ুথ সেন্টারের ফান্ডরেইজ করার জন্য। যাবার কালে তিনি আমাকে রিকুয়েস্ট করেছেন আমি যেনো ফোনটি রাতে বন্ধ না রাখি। 

আমরা যেহেতু এক সাথে কমিউনিটি ওয়ার্ক করি সেহেতু তাঁর অনুপস্থিতিতে হয়তো আমাকে কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হতে পারে। সময়ের পার্থক্যের কারণে তিনি যখন আমাকে কল করেছেন তখন অস্ট্রেলিয়াতে মধ্য রাত। 

এখনই আমাকে একটি ডেডবডি কালেক্ট করতে যেতে হবে। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না, কেননা এই মৃতদেহটি যেখান থেকে কালেক্ট করতে হবে সেটি একটি এইজড কেয়ার সেন্টার। ওদের ওখানে মৃতদেহ রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। সকাল হলে অন্য একটি ফিউনারেল সার্ভিস কোম্পানী মৃতদেহটি নিয়ে যাবে। আর যদি ওরা মৃতদেহটি নিয়ে যায় তাহলে তাঁরা মৃতদেহটি ক্রিমেইট করবে, অর্থাৎ পুড়িয়ে ফেলবে। 

পশ্চিমা দেশগুলোতে কতটা ভয়ানক ঘটনা ঘটতে পারে তেমনই একটি অভিজ্ঞতার গল্প আজ আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।

কীভাবে কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। এর আগে এমন কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার কখনোই হয়নি। তারউপর এতো রাতে আমাকে একা এই কাজটি করতে হবে। ভীষণ নার্ভাস লাগছে, কিন্তু কাজটি আমাকে করতেই হবে। দ্বিতীয় কোনো অপশন নেই। 

হাসিন গস আমাকে মোটিভেইট করার চেষ্টা করছেন প্রতিনিয়ত। তিনিও জানেন আমার একার পক্ষে এই কাজটি করা মোটেই সহজ নয়। তাই বারবার আমাকে কল করে মোটিভেইট করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন আমি যেনো কাজটি যথাযথভাবে করতে পারি। 

শীতের রাত। বাড়ি থেকে বের হলাম। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছে বেশ দিন। বাইরে বেরোতেই মনে হলো ঠাণ্ডাতে জমে যাচ্ছি। গাড়ির হিটারটা আমার ঠাণ্ডা দমাতে পারছে না। হাত পা থরথর করে কাপছে। এমনিতে আমি খুব সাহসী একজন মানুষ। তবে আজ রাতে ভীষণ নার্ভাসে হয়তো ঠাণ্ডা একটু বেশি লাগছে। 

লাশ আনতে হলে লাশের গাড়ি নিতে হবে। আমার গাড়িটা চলছে লাশবাহী গাড়ির ঠিকানায়। শীতের রাতে চারিদিকে সুনশান নিরবতা। ধীরে ধীরে গিয়ে লাশবাহী গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি থেকে কর্পূর জাতীয় পদার্থের তীব্র গন্ধ নাকে লাগছে। 

গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছি, কিন্তু গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। কনকনে ঠাণ্ডায় হয়তো বেটারি ফ্ল্যাট হয়ে আছে। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। এতো রাতে হেল্প করার মতো আশেপাশে কেউ নেই। গাড়ির টুলবক্সে জাম্পার ক্যাবল খুঁজে পেলাম। আমার গাড়ির সাথে জাম্পার ক্যাবল কানেক্ট করে কয়েকবার চেষ্টার পর গাড়িটি স্টার্ট নিলো। 

একেবারে শূন্য রাস্তা। আমি আর লাইট পোস্ট ছাড়া তেমন কাউকে চোখে পড়ছে না। লাইট পোস্টগুলোর নিচে কুয়াশার চাদর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চলছে আমার গাড়ি। নিদৃষ্ট ঠিকানায় পৌঁছুতে ত্রিশ চল্লিশ মিনিটের মতো সময় লাগলো। ঠিকানাতে পৌঁছে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ না করে গেইটের দিকে এগিয়ে গেলাম। ডোর বেল প্রেস করতেই একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এসে ডোরটি খুললেন, এবং জিজ্ঞেস করলেন আমি ডেডবডিটি নিতে এসেছি কিনা। নিজেকে মৃতব্যক্তির ছেলে পরিচয় দিয়ে আমাকে ভিতরে যেতে বললেন। 

আমি স্ট্রেচারটি গাড়ি থেকে না নামিয়েই ভিতরে প্রবেশ করলাম। যে রুমে ডেডবডিটি রয়েছে সেই রুমের সামনে যেতেই দুজন মহিলার একজন সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি ডেডবডিটি নিতে এসেছেন? আমি বললাম, হ্যা। তাঁদের মধ্যে একজন মহিলা আমাকে ডেথ সার্টিফিকেট আর ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এগুলো রাখুন, আপনার জন্য তৈরি করে রাখা হয়েছে। 

আমি গাড়ি থেকে স্ট্রেচার নামিয়ে নিয়ে আসলাম। রুমে ঢুকতেই ভদ্রলোক পিতার মৃতদেহটি স্ট্রেচারে উঠাতে সাহায্য করলেন। ডেডবডিটি একটি বিশেষ প্লাস্টিক ব্যাগে মোড়ানো। মনে হলো ডেডবডি বহন করার জন্যই এই ব্যাগগুলো তৈরি করা হয়েছে।  

তিন চারজন মিলে ব্যাগের ভিতর মোড়ানো ডেডবডিটি স্ট্রেচারে উঠালাম। স্ট্রেচারের বেল্টগুলো ধীরে ধীরে লাগাচ্ছি। বেল্টগুলো লাগাতে গিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো আমার। মনে হলো আমি নিজেই যেনো নিজের ডেডবডিটি স্ট্রেচারে স্ট্রেপ করছি। মনে হলো অনেক দিনের অভিজ্ঞ একজন মানুষ আমি। অতি সাবধানে এমনভাবে বেল্টগুলো লাগালাম যেনো ডেডবডিতে সামান্যতম ব্যথা না লাগে। 

আমার সাথে সাথে ভদ্রলোক গাড়ি পর্যন্ত এলেন, বললেন, হাসিন গসের সাথে আমি বিস্তারিত কথা বলেছি। সকাল ১০টার দিকে যাবতীয় কাগজপত্রে স্বাক্ষর দিতে আসবো। আমি ডেডবডিটি গাড়িতে উঠালাম। নিশ্চিত হলাম স্ট্রেচারটি সঠিকভাবে লক করা হয়েছি কিনা। সবকিছু ঠিকঠাক। 

ফিরে আসছি আমি। এবার গাড়িটি চলছে মসজিদের দিকে। নিজের কাছে মনে হচ্ছে আমি নিজেই নিজের লাশটি বহন করে চলেছি। অজানা এক অন্যরকম অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আমার মনে। কিছুটা ভয়, কিছু অজানা ভাবনায় চালাচ্ছি লাশের গাড়ি। ভাবতে ভাবতে কখন যে মসজিদের সামনে এসে গেছি বুঝতেই পারিনি। সকাল, তখন চারটা বাজে।

ডেডবডিটি মসজিদের ওয়াশ রুমে অপেক্ষা করছে। ফজর সালাত এখনো দুই ঘন্টা বাকি। আমি বাড়ি এসে ফ্রেশ হলাম। ফজরের পর এসে দেখলাম দুজন ভলান্টিয়ার এসেছেন ডেডবডি ওয়াশ করার জন্য। তাঁরা জানেন ওয়াশের পর কোথায় লাশ রাখতে হবে। আমি বাড়ি এসে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। 

সকাল ১০টার দিকে কল পেলাম। ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন। আমি তৈরি হয়ে দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সকল পেপার ওয়ার্কস করার জন্য। 

অফিসের দরজায় বেশ কয়েকজনের ভিড়। সামনের দিকে এগুতেই ভদ্রলোক পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর দুই বোনের সাথে। আমি আশ্চার্য হলাম। মুসলিম নারীরা কীভাবে প্রাশ্চাত্যের নারীদের ন্যায় এভাবে পর্দাহীন চলতে পারে। আমি সালাম দিলাম, কিন্তু তাঁরা কেউ উত্তর দিলেন বলে মনে হলো না। মনের ভিতর একটু খটকা লাগলো। 

অফিসে গিয়ে বসতেই সবাই আসলেন। ছেলেই প্রথম বললেন যে তাঁদের মধ্যে একটু ঝামেলা হয়ে গেছে। একান্তে আমার সাথে আলোচনা করতে চান। আমি সবাইকে অফিস কক্ষে বসিয়ে দরজা লক করে দিলাম। 

সবার কথা শুনে বুঝলাম, বিশাল এক পারিবারিক ডিসপিউট। মেয়েরা ধর্ম মানেন না। তাঁরা তাঁদের জন্মদাতাকে ক্রিমেইট করতে চান, অর্থাৎ পুড়িয়ে ফেলতে চান। আর ছেলে চান তাঁর বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে। ছেলে নিজেও ধর্ম মানেন না, তবে বাবার শেষ দিনগুলোতে কাছে ছিলেন বলে বাবার ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানাতে চান। কিন্তু মেয়েরা চান মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলতে, খরচ যতই হোক, এটাই নাকি সবচেয়ে সহজ উপায়। 

বুঝলাম, আমার পক্ষে এই কেইস হ্যান্ডল করা সম্ভব নয়। আমি দুই পক্ষকেই বললাম নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তাঁদের বাবার ইচ্ছাটি পূরণ করতে। তাঁরা ঐক্যমতে পৌঁছুতে পারলেন না। দুই বোনের মধ্যে একজন রাজি হলেও অন্যজন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না যে তাঁর বাবা একজন মুসলিম ছিলেন, এবং মুসলিম রীতিতে লাশের ব্যবস্থা হবে। 

তাঁরা চলে গেলেন। আমি বিষয়টি মুসলিম কমিউনিটির সদস্যদেরকে জানালাম। তাঁরাও বিস্মিত হলেন, এবং যার যার অবস্থান থেকে আপ্রান চেষ্টা করতে লাগলেন। 

দুইদিন পর হাসিন গস ফিরে এলেন। তিনি সবই জানেন। নতুন করে আমার বলার কিছু ছিল না। তিনি সহ কমিউনিটির সিনিয়ররা পরিবারের সাথে কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু কোনোভাবেই সমাধান হচ্ছে না। এদিকে বাবার লাশ মসজিদের হীমঘরে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। 

প্রতিনিয়ত আলোচনা শেষে প্রায় দশ দিন পর সমাধান হলো। পরিবারের সবাই একমত হলেন। তাঁদের বাবাকে ক্রিমেইট করা হবে না। ইসলামিকভাবে জানাজা দিয়ে কবরস্ত করা হলো।

আমরা যারা প্রাশ্চাত্যে বসবাস করি তাঁদের জন্য এটি একটি কঠিন বার্তা। 

আপনি যদি মুসলিম হয়ে থাকেন তাহলে, নিজে ইসলাম পালন করুন, এবং নিজের সন্তানদের সঠিকভাবে ইসলাম শিক্ষা দিন। তাঁদেরকে দ্বীন পালনে উৎসাহীত করুন। এই পৃথিবীতে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি তা তাঁদেরকে শিক্ষা দিন। তা না হলে তাঁরাও একদিন ঐ সমস্ত হাজারো পরিবারের মতো প্রাশ্চাত্যের হাওয়ায় হারিয়ে যাবে। আর যদি তাঁরা হারিয়ে যায় তাহলে আমাদেরকে তাঁদের এই পরিনতির ভাগিদার হতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
sr7themes.eu.org